1870s Bangla Girls' School: A History PDF

Document Details

SkilledBildungsroman

Uploaded by SkilledBildungsroman

Sidho-Kanho-Birsha University

Tags

bangla history women's education 19th-century bangladesh historical accounts

Summary

This document tells the story of a girl's school in 19th-century Bengal, highlighting the challenges and progress in women's education. It discusses the establishment of the school, the struggles of its founders, and the achievements of its students. The document features individuals involved with the school and its impact on the larger society.

Full Transcript

# সেকালের একটা মেয়ের গল্প সেকালের একটা মেয়ের গল্প বলছি শোন। সেকাল বলতে কোন কাল? এমন কিছু নয়, শ'দেড়েক বছর আগের হবে। আজ হয়তো মনে হবে-সতেরোশ' সাতান্নয়-পলাশীর যুদ্ধ, আঠারোশ' সাতান্নয়-সিপাহী যুদ্ধ। এর বছর চারেক পরের কথা। বম্বে থেকে থানে-রেল চলেছে। ক'মাস পরেই পূর্ব রেল-যার আদি নাম ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে-আগ...

# সেকালের একটা মেয়ের গল্প সেকালের একটা মেয়ের গল্প বলছি শোন। সেকাল বলতে কোন কাল? এমন কিছু নয়, শ'দেড়েক বছর আগের হবে। আজ হয়তো মনে হবে-সতেরোশ' সাতান্নয়-পলাশীর যুদ্ধ, আঠারোশ' সাতান্নয়-সিপাহী যুদ্ধ। এর বছর চারেক পরের কথা। বম্বে থেকে থানে-রেল চলেছে। ক'মাস পরেই পূর্ব রেল-যার আদি নাম ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে-আগেই চলত-নেহাত কলকাতার 'স্যান্ড হেডস্'-এ তার ইঞ্জিন, কামরা-সমেত জাহাজটির সলিল সমাধি হয়ে গেল-তাই! এদিকেই সাহেবদের নজর বেশি ছিল, কেননা রানীগঞ্জে কয়লা রয়েছে না? আগের রেলগাড়ি ঝমাঝম যে চলত-তার কয়লা, জাহাজের কয়লা! দাম বেশি। সে কথা থাক। এটা হচ্ছে আঠারোশ' একষট্টি সালের কথা। সালটাই বিষম বিখ্যাত কেন জানো-এই সালেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জগত-আলো-করা ছেলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম-পঁচিশে বৈশাখ-৭ মের শেষ রাতে। ওই বছরই কিছুদিন পরে জন্মালেন-আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অবশ্য খুলনায়। আর জন্মালেন-আমাদের ঝড়ের মেয়ে কাদম্বিনী-তবে বৃহত্তর বাঙলায়-ভাগলপুরে। -শরৎচন্দ্রের মামার বাড়ি-এখানের একটা ঘরে বসেই তিনি 'শ্রীকান্ত' লিখেছিলেন বলে শোনা যায়। সে ঘরটা নাকি আছে-আছে তাঁর 'হুঁকো'-যদিও সংরক্ষণে নাকি খাস্তি আছে। সে যাই হোক, এখন কাদম্বিনীর কথায় আসি। শ্রাবণের আকাশের মেঘ দেখে, খুশি বাবা ব্রজকিশোর বসুর কদম্বপুষ্পের আবাহনকারী মেঘপুঞ্জের কথাই বোধ হয় মনে এসেছিল-তাই সোনার মতো রঙ, এক আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ের নাম দিলেন কাদম্বিনী। দু'ছেলের পর মেয়ে। তারপরও কাদম্বিনীর এক ভাই হয়েছিল। সেকথা পরে হবে। ব্রজকিশোর কিন্তু ভাগলপুরের আদি বাসিন্দা নন। তিনি ছিলেন চাঁদসির জমিদার। জেলা বরিশাল। কিন্তু জমিদারি নয়তো যম। অন্তত ব্রজকিশোরের বেলায়। অংশীদারেরা এমনই কালান্তক, মারকুট্টে, যে বাগে পেলেই মেরে ফেলবে। আদরের ভাইকে এস্তাদিদি সোজা চাঁদসি থেকে সরিয়ে এনে সুদূর ভাগলপুরেই থিতু করে দিলেন। ব্রজকিশোরের একটা স্কুল মাস্টারিও জুটে গেল। লেখাপড়া জানা ছেলে। সংসার পেতে বসলেন ভাগলপুরে। জায়গা চমৎকার। পূর্বে পুণ্যতোয়িনী গঙ্গা-আর পিছনে মন্দার পর্বতের পাদদেশ। আর একটু দূরে বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক'-এর লবটুলিয়ার জঙ্গল। ওখানে এককালে রেশমও তৈরি হ'ত। 'সিল্ক সিটি'রও অভিধা জুটেছিল শহরের। দিনে দিনে বাড়ে কাদম্বিনী। কাদম্বিনীর পড়াশুনা-বাবার কোলে বসেই শুরু বোধ হয়। কিছু পরে ডাক্তার কৃষ্ণধন ঘোষ পাঁচ-ছয়টা ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা স্কুল খুললেন-কাদম্বিনী তাতেই ঢুকে গেলেন। কাদম্বিনীর ভাগলপুর জীবন প্রায় কিছুই জানা যায় না। তার বাবা, কালক্রমে হেডমাস্টার হয়েছিলেন, এবং জীবনের শেষদিকে বহরমপুর কলেজ বা কলিজিয়েট স্কুলে মাস্টারি করেছিলেন। সেখানেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সর্দি-গর্মিতে, হাঁপানির রোগী ছিলেন যে। তবে ব্রজকিশোর-কেশবচন্দ্র সেন যখন ভাগলপুর যান-তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে ব্রাহ্ম হয়ে যান। আবার 'কুচবিহার-বিবাহের গণ্ডগোলে'-সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ হ'লে তাতে যোগ দেন। তবে নারীমুক্তি আন্দোলনে তিনি বেশ কিছুটা সক্রিয় ছিলেন। অভয়াচরণ মল্লিক নামে এক ভদ্রলোকের সহযোগিতায় তিনি ভাগলপুরে মহিলা সমিতি তৈরি করেন। দেশের এইটেই নাকি প্রথম মহিলা সমিতি! এখন কাদম্বিনীর কথায় আসি। এখন তো তোমরা হাজারে হাজারে স্কুল ফাইন্যাল দিতে যাচ্ছ। আগে এই পরীক্ষাকে বলত ম্যাট্রিক পরীক্ষা। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চালাত। তারও আগে বলত এন্ট্রান্স-এটাও সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। সিপাহী যুদ্ধের বছরে আঠারোশ' সাতান্নয় যার শুভ উদ্বোধন। ভারতবর্ষে তখন তিনটে প্রেসিডেন্সি-কলকাতা, বম্বে আর মাদ্রাজ। বম্বে, মাদ্রাজেও বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হল, কলকাতারই সঙ্গে। এখন যেকথা হচ্ছিল-সেকাল বলতে আমি সে সময়ের কথা বলছি যখন-মেয়েদের লেখাপড়াই শেখান হত না, অবশ্য দু'চার রহিস বাড়ি ছাড়া। -সাধারণ বিশ্বাস-লেখাপড়া শিখলেই নাকি বৈধব্য, কাগজে কালি টানলেই কুলে কালি কুলীন বা ঘাটের মড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে জাত-কুল বাঁচাচ্ছে সমাজ! অবশ্য রাজা রামমোহন রায়, করুণাসাগর দয়ারসাগর বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে-মেয়েরা প্রাথমিক স্কুলে পড়তে যাচ্ছে-কিন্তু ওই অবধিই। প্রথম পট পাল্টাল এই কাদম্বিনীকে নিয়ে। গল্পটা আগে থেকে বলা যাক। কাদম্বিনী তো ভাগলপুরের মেয়ে। কলকাতায় এল কবে। এল কার কাছে, কিভাবে, কোথায়-এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই। কলকাতা হাইকোর্টের চিফ জ্যাস্টিস সার জে বি ফিয়ার, কলকাতা হাইকোর্টের বাঙালি জজ-দ্বারকানাথ মিত্র, মনোমোহন ঘোষ, দুর্গামোহন দাস আর কেশব সেন মশায়কে নিয়ে। আর কুমারী এ্যাক্রয়েড হলেন সম্পাদিকা-আর ইংরেজিরও শিক্ষিকা। স্কুলের নাম হল 'হিন্দু বোর্ডিং স্কুল।' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ধরে পড়াশুনা। আঠারোশ' তিয়াত্তরের আঠারোই সেপ্টেম্বর। শরৎকাল। 'আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা। নবীনধানের মঞ্জুরী নিয়ে সাজায়ে এনেছি ডালা।' আকাশ নীল। মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা। আশ্চর্য ঝকঝকে আকাশের তলায় পাঁচটি মেয়ে বইপত্র নিয়ে বাইশ নম্বর বেনেপুকুর লেনের এক ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠল। শহরের উপকণ্ঠে তখন সাদা কাশ মাথা নেড়ে চলেছে। গাঢ় সবুজনীল গাছের পাতায় নতুন সূর্যের আলো পড়ে পৃথিবীটাকে মায়াময় করে তুলেছে। ক'দিন বাদেই দুর্গাপূজা। অনেক বনেদি বাড়িতেই প্রতিমার কাঠামোয় একমেটে হয়ে গেছে। এই খুশিখুশি পরিবেশে বিনা ঢাকঢোলে একেবারে বলতে গেলে নিঃশব্দে একটা ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটে গেল। মেয়েদের শিক্ষার জন্য বেথুন সাহেব স্কুল করেছিলেন হেদুয়ার ধারে কত ঢাকঢোল বাজিয়ে। অশ্বত্থ চারা রোপন করে চিরজীবীর স্বপ্ন দেখে। গাড়ি করে বাড়ি বাড়ি থেকে মেয়ে নিয়ে আসত। তাঁর স্কুলের এখন টিম টিম অবস্থা! এ স্কুল-বোর্ডিং স্কুল-মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল। পাঁচটি ছাত্রী। বইপত্র নিয়ে এখানে পড়বে, থাকবে, খাবে। সবকিছুর আয়োজন। এই স্কুলের পণ্ডিত হলেন দ্বারকানাথ। শ্রীমতী ফিয়ার ও অবৈতনিক শিক্ষিকা হয়ে পড়াতে লাগলেন মেয়েদের। আর দ্বারকানাথ-ইংরেজি ছাড়া সব বিষয়ই পড়ান-আর করেন মেয়েদের দেখভাল। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। এই স্কুলের ছাত্রী লেডি অবলা বসু তাঁর স্মৃতিচিত্রণে জানিয়েছেন-'স্কুলের সব বন্দোবস্ত এমনকি রুটিন পর্যন্ত দ্বারকানাথের।' সর্বব্যাপী তাঁর অস্তিত্ব। বেশ চলছিল স্কুল। মাঝে একটা গোলমাল হয়ে গেল। কেশব সেন মশায় দুটো কাগজ চালাতেন—একটা ইংরেজিতে 'ইন্ডিয়ান মিরর' আর এক পয়সার বাঙলা কাগজ 'সুলভ সমাচার'। এই কাগজে কেশব সেন মশায় এই নতুন স্কুলের পাঠ্যক্রমকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন। খবরটা অচিরে ইংরেজ শিক্ষয়িত্রী-মিস এ্যাক্রয়েডের কর্ণগোচর হল এবং তিনি তাঁর ক্রোধ প্রকাশ করলেন। ব্যাপারটা কেশব সেন মশায়ের কানে যেতেই তিনি ম্যানেজিং কমিটি থেকে তাঁর পদত্যাগ পত্র সেক্রেটারি মেমসাহেবকে পাঠিয়ে দিলেন এবং সে চিঠি ম্যানেজিং কমিটিতে প্রথামত পেশ না করেই মিস এ্যাক্রয়েড তা গ্রহণ করলেন। এই নিয়ে কেশবের দলবল খুব হইচই করল । মেমসাহেবের হয়েও ব্রাহ্মসমাজের একদল কাগজে চিঠি দিয়ে জানালেন, মেমসাহেব কিছু অন্যায় করেননি-এই চিঠির লেখকদের মধ্যে ছিলেন-রামতনু লাহিড়ী, শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীনাথ রায়, দ্বারকানাথ, দুর্গামোহন দাস, ক্ষিরোদচন্দ্র রায় প্রমুখ তেইশ জন। আসলে, বিলেত থেকে ফিরে কেশব সেন নিজেই তাঁর ব্রাহ্মআশ্রমে একটা মেয়েদের স্কুল খুলেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী সেখানে পড়িয়েছিলেনও কিছুদিন। কেশব এই বিশ্ববিদ্যালয়-পাঠ্যক্রমে মেয়েদের পড়াশুনা মেনে নেননি। তাঁর বক্তব্য-সংসার ভালো করে চালাতে যা যা জানা দরকার, মেয়েরা তাই পড়লেই যথেষ্ট। এই রক্ষণশীলতাই এই সংঘর্ষের কারণ। ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গীগত। ব্যক্তিগত নয়। সে যাই হোক, স্কুল তো দিব্যি চলছিল। মেরি কার্পেন্টার একদিন স্কুল পরিদর্শনে এসে ভারি খুশি। দুই ছাত্রীকে হাজার টাকার বৃত্তি স্বীকার করে গেলেন। শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে গেলেন মেয়ে দুটোর নাম তাঁর কাছে পাঠাতে। মিস এ্যাক্রয়েড মাস মাস চাঁদা পেতেন একশো ছিয়াশি টাকা। আরও এককালীন সতেরোশ' একান্ন টাকা সংগ্রহ করে ফেললেন। নিজে দিলেন একশো'। এছাড়া মাসে চল্লিশ টাকা। টাকাকড়ির খাস্তি রইল না কোনোমতেই। তাছাড়া দায়ে-অদায়ে দুর্গামোহন আছেন, আছেন মনোমোহন। সব ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু এক ঘটনায় ভণ্ডুল হয়ে গেল সব। মিস এ্যাক্রয়েড হয়ে গেলেন মিসেস বেভারিজ। বাখরগঞ্জের 'জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঐতিহাসিক হেনরি বেভারিজের সঙ্গে মিস এ্যানিটা সুশান এ্যাক্রয়েডের বিয়ে হয়ে গেল ছয়ই এপ্রিল। ১৮৭৫ আর, সুশান চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্বামীর ঘর করতে সুদূর বাখরগঞ্জে চলে গেলেন ৩ মার্চ ১৮৭৬। সাময়িক নোঙরহীন নৌকোর মতো স্কুল অচল হয়ে গেল। টিকল না। কুল্লে আড়াই বছর চলেছিল স্কুলটা। কিন্তু তখন বঙ্গজন মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে বদ্ধ-পরিকর। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি আছেন না, বাঙালের গোঁ। তিনি আদাজল খেয়ে লেগে পড়লেন। প্রথমেই জানালেন তাঁর প্রধান আশ্রয়স্থল-এবং যাঁর এই মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে আগ্রহের অন্ত নেই, সেই দুর্গামোহন দাসের স্ত্রী ব্রহ্মময়ী দেবীকে। তিনি ঝনাৎ করে একশো' টাকা মাসে মাসে দেবার অঙ্গীকার করলেন। আর একজন নতুন বিদ্যোৎসাহীকে সঙ্গে পেলেন দ্বারকানাথ। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সির নামকরা পয়লা নম্বর ছাত্র, আনন্দমোহন বসু। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলারশিপের টাকায় বিলেত গেলেন। কেমব্রিজে-র‍্যাঙ্গার হয়ে ফিরে এলেন। প্রথম ভারতীয় র‍্যাঙ্গার। তিনিও কাঁধে কাঁধ লাগালেন। মাস তিনেকের মধ্যেই নতুন স্কুলের দ্বারোদঘাটন হয়ে গেল-এখনকার বালিগঞ্জ ডাকঘরের কাছে-ওল্ড বালিগঞ্জ রোডে। সেই বছরই পয়লা জুন। বলা বাহুল্য, দ্বারকানাথ দশ হাতে যেন কাজ করতে লাগলেন-শিক্ষকতা থেকে কুলির কাজ। আর পাঠ্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনুসারী। নতুন স্কুলের নাম হল 'বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়'। শিবনাথ শাস্ত্রীকে ধরে তাঁর মেয়ে হেমলতাকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন দ্বারকানাথ। এখন স্কুলে পড়াশুনা কেমন চলছে? আঠারোশ' সাতাত্তর সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বসল পরীক্ষায়। জুলাই মাসে পরীক্ষা হল। সেই মাসেই খবর বেরোয়। মোট পরীক্ষার্থিনী ছিলেন ৪৩ জন। পাশ করে ১৩ জন। শতকরা ২৮ জন। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় থেকে প্রথম হন কাদম্বিনী বসু; বয়স তখন ১৪। মোট আড়াইশোর' মধ্যে পান ১৫১। দ্বিতীয় হল সরলা দাস-ওই স্কুলেরই ছাত্রী-পান ১৩৮, (এঁরা সব ক্লাস এইটের ছাত্রী)। আর ওই স্কুল থেকে যাঁরা পাশ করেছিলেন সুবর্ণপ্রভা বসু; (ক্লাস সেভেনের ছাত্রী) আর ক্লাস সিক্সের ছাত্রী অবলা দাস আর সরলা মহলানবিশ। কাগজে এই রিপোর্ট পুরোটা ছাপা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ক্লাস এইটের ছাত্রীদের ইংরেজি উত্তরপত্র এতই ভালো হয়েছিল যে তাদের লেখা 'এন্ট্রাসের ছাত্রদের সমতুল। এখানে কাদম্বিনী সম্বন্ধে একটা মজার গল্প বলে নিই। সেকালের কাগজে মেয়েদের স্কুলের পরীক্ষায় বাঙলার খাতায় যে সব রচনা লিখতে দেওয়া হত' তার থেকে সবচেয়ে ভালো রচনাটা কাগজে ছেপে দিতেন সম্পাদক। 'বামাবোধিনী' বলে একটা কাগজ চালাতেন উমেশচন্দ্র দত্ত মশায়। কাদম্বিনীর বার্ষিক পরীক্ষার উত্তরপত্রে লেখা একটা রচনা 'নারিকেল বৃক্ষ', 'বামাবোধিনী'র আষাঢ় সংখ্যায় বেরিয়েছিল; রচনাটা একটু তুলে দিচ্ছি : 'দূর হইতে নারিকেল বৃক্ষশ্রেণী দেখিতে কি মনোহরই হয়। যখন সায়ংকালে মৃদু মৃদু বায়ু হিল্লোলে নারিকেল বৃক্ষ সকল নড়িতে থাকে তখন মনে কি অনির্বচনীয় আনন্দ উপস্থিত হয়। দয়াময় ঈশ্বর যে আমাদের অভাব জানিয়া নারিকেল বৃক্ষ সৃজন করিয়াছেন তজ্জন্য তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিতেছি। যদি এই বৃক্ষ এতদ্দেশে সৃজন না করিতেন তবে এখানকার লোকের কত কষ্ট হইত বলা যায় না। গ্রীষ্মের পিপাসাকালে নারিকেল জলপান করিয়া যে সুখানুভব হয়, তাহা হইত না!' সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর মন্তব্যে লিখেছেন: 'সম্প্রতি কলিকাতার উপনগরস্থ বালিকা বিদ্যালয় সকলের যে বার্ষিক পরীক্ষা হয় তাহাতে যত ছাত্রী রচনা লিখিয়াছেন, তন্মধ্যে ইঁহার রচনা সর্বোৎকৃষ্ট হইয়াছে। স্ত্রীলোকেরা বিদ্যা ও ঈশ্বর বিষয়ে সচরাচর রচনা লিখিয়া থাকেন। কিন্তু 'নারিকেল বৃক্ষ' সম্বন্ধে উপস্থিত প্রশ্ন পাইয়া যে বালিকা এইরূপ সুসজ্জিত রচনা লিখিতে পারেন তাঁহার শিক্ষা ও রচনা দক্ষতার প্রশংসা করিতে হয়।' সাধু বাঙলায় রচনার স্টাইল ঋজু এবং সহজ। সম্পাদকের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায়ই নেই। বোর্ডিং হাউসে কাদম্বিনীর পড়াশুনা দিব্যি চলছে। এবং স্কুলের সুনাম বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। ওদিকে বেথুন সাহেবের সেই সাধের স্কুল যার উন্নতির জন্য তিনি তাঁর স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন, তার অবস্থা শোচনীয়। মেয়ে নেই-যাও আছে, পড়ায় মন নেই। স্কুলে আসতে হয়, তাই আসে। অথচ তার পিছনে রয়েছে ব্রিটিশ সরকার। তারও কর্মকর্তা-জজ সাহেব। আছেন, কাদম্বিনীর পিসতুত দাদা মনোমোহন! তিনি একদিকে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের স্কুল কমিটির একজন, অপর দিকে বেথুন স্কুলের সেক্রেটারি। শত সরকারি সাহায্য সত্ত্বেও বেথুন স্কুলের সেই রিকেটি চেহারার কোনো পরিবর্তন নেই। মনোমোহন তখন উদ্যোগী হয়ে বেথুন স্কুলের প্রেসিডেন্ট নবাগত চিফ জাস্টিস-সার রিচার্ড গার্থকে সরাসরি অনুরোধ করলেন, বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় একবার পরিদর্শন করতে। হাজার হোক মনোমোহন 'বার'-এর একজন নামকরা সদস্য। কাজেই সার রিচার্ড রাজি না হয়ে পারলেন না। একদিন চিফ জাস্টিসের সুসজ্জিত বিশাল ফিটন গাড়ি এসে দাঁড়াল ওল্ড বালিগঞ্জ রোডের সেই 'ভাড়া' করা বাড়িটার দরজায়। খবর সব দেওয়াই ছিল। কর্তাব্যক্তি, মাস্টারমশায়রা সব বেরিয়ে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন দশাশয়ী সাহেব অভ্যাগতকে। সঙ্গে নামলেন মনোমোহনও। সার রিচার্ড-স্কুলের মেয়েদের আচার-আচরণ, লেখাপড়া-সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। মুখচোখ প্রসন্নতায় ভরে গেল। আঠারোশ' আটাত্তর। জুন মাসের শেষ। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের এইটেই শেষ পরিদর্শন। তবে একথা যেন ভাবা না হয় শুধু মনোমোহনের আবেদনে সাড়া দিয়েই সার রিচার্ড গার্থ স্কুলটা পরিদর্শন করতে এলেন। আসলে এই স্কুলটা শুরু হবার পর থেকেই তার নামডাক হয়। একদিন ছোটলাট দেখতে এলেন। মেয়েদের লেখাপড়ার মান তাঁকে মুগ্ধ করে। গ্রান্ট সাহেবও পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। তিনি দেখলেন ছয়টা ক্লাসের দু'টি মেয়ে-কাদম্বিনী আর সরলা ইউক্লিডের জ্যামিতি আর এ্যালজাবরায় জিলা স্কুলের সেকেন্ড ক্লাসের উপযুক্ত। এবং তাদের সামগ্রিক লেখাপড়ার মান দেখে তাঁর মনে হয়েছে, তারা আসছে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার উপযুক্ত। মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার মান বেশ ভালো। সরকারি শিক্ষাবিভাগের একটা রিপোর্টে বলা হল বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় বাঙলাদেশের সবদিক দিয়ে উন্নত স্কুল। তাদের একটা ভারি টাকা অনুদানের আবেদনও তাঁরা মঞ্জুর করে দিলেন। এইসব রিপোর্ট ঠিকই সার রিচার্ডের কানে এসেছিল। সেই জুনের গরমেও আগ্রহী সাহেব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্কুলের পরিদর্শন সম্পন্ন করলেন। এবং বুঝতে দেরি হ'ল না যে বাঙালিদের এই স্কুল সাহেবদের স্কুল বেথুন থেকে অনেক উন্নত। বেথুনের চেয়ে অনেক উন্নত এখানের মেয়েদের লেখাপড়ার মান। কাজেই, পরের ঘটনা খুব দ্রুতই ঘটে গেল। বেথুন স্কুলের সঙ্গে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের একীকরণ হয়ে গেল। ম্যানেজিং কমিটিতে মনোমোহন তো সেক্রেটারি-আর বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় থেকে এলেন দুর্গামোহন দাস আর আনন্দমোহন বসু। বেথুন সাহেবের আত্মা শান্তিলাভ করল। তাঁর স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। তবে কোনো কাজই বিনা বাধায় হয় না। সেকালের সেরা কাগজ কেশব সেনের 'ইন্ডিয়ান মিরর'। এক পয়সার কাগজ 'সুলভ সমাচার' ত আছেই, নবগোপাল মিত্রের 'ন্যাশনাল,' 'খৃষ্টান হেরল্ড' সবাই 'গেল গেল' রব তুলল। বালির বাঁধে যেমন বন্যার জলতরঙ্গ আটকায় না; এঁদের লেখালিখি মিছেই হল। একীকরণ আটকাল না। কিন্তু আবার এক তোলপাড় কাণ্ড। আর এক বিরাট ঝড়। ব্যাপারটা কি-না কাদম্বিনী আর সরলা দু'টি বেথুনে পড়ছে। মাস্টারমশায়রা সব একবাক্যে বললেন, এঁরা এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার উপযুক্ত। কিন্তু এন্ট্রান্স পরীক্ষা তো নেয় কলকাতা বিশ্ব-বিদ্যালয়-তাঁরা দিতে দেবেন, তবে তো মেয়েরা পরীক্ষা দেবে! সে যে জগদ্দল পাথর। তাকে নড়াবে কে? চিফ জাস্টিস নিজে দেখে এসেছেন, জানেন মনোমোহন ঘোষ। আর সাধারণ ব্রাহ্ম-সমাজের দুর্গামোহন দাস, আর আছেন এদের শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি। এই নিয়ে কাগজে কাগজে লেখালিখি হতে লাগল। তখন অবশ্য ভাইস চ্যান্সেলার ছিলেন সার আরথার হবহাউস। তবে এই মেয়েদের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার কাহিনীতে আর একটা বাঙালি মেয়ের কথা এসেই যায়। তিনি চন্দ্রমুখী বসু। বাবা ভুবনমোহন বসু। এঁরা খ্রিষ্টান। আদি বাড়ি শোনা যায় হুগলি জেলার মহানাদ। সেখান থেকে সোজা চলে গিয়েছিলেন শৈলশহর দেরাদুনে। চন্দ্রমুখীর পড়াশুনায় খুব আগ্রহ দেখে বাবা ভর্তি করে দিলেন ভেরা বোর্ডিং স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান গার্লস-এ। দিদিমণিরা মেয়েটিকে খুবই ভালোবাসেন। বাপের বড় মেয়ে-একটু আবদেরে। মিসিবাবারা একটু বেশি স্নেহ করেন কেননা মেয়েটি লেখাপড়ায় খুব ভালো। সেদিন হ'ল কি, মেয়েটি একেবারে স্কুলের খাস রেকটর রেভারেন্ড হেরনের কামরায় গিয়ে হাজির। টেবিলে কি একটা কাগজে ব্যস্ত ছ

Use Quizgecko on...
Browser
Browser